সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০১:৩৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মেধা উপচে কই কই পড়ছে?

মোস্তফা কামাল:
দৃশ্যত, মেধার কমতি-ঘাটতি আছে কারও মধ্যে? কথায়, বাক্যে, শব্দে? বরং সবার মধ্যেই মেধার কিলবিল। সবদিকেই মেধা উপচে পড়ার অবস্থা। এ সময়ে আবার চমকের খবর দিয়েছে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। জানিয়েছে, এবার মেধার জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন তারা। সামনে তাদের কমিটি মেধায় আরও ভরিয়ে দেওয়া হবে। এবার ছাত্রদলের নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ পাঁচজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া মানেই মেধাবী? সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ফিজিক্স শেষ করে এখন অন্য একটি বিষয়ে পড়ছেন। সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির জাপানিজ স্টাডিজ থেকে মাস্টার্স করেছেন; এখন সেন্ট্রাল ল কলেজে আইন বিষয়ে পড়ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বর্তমানে একই বিভাগে এমফিল করছেন। ঢাবির সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে এখন মাস্টার্স করছেন।

তারা অবশ্যই মেধাবী। কেবল তাদের নয়, কারও মেধাকেই খাটো করে দেখা যায় না। স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি এবং ছাত্রদলের কাছে এটি গর্বের। এতে তারা ঘুরে দাঁড়াবেন বলে যারপরনাই আশাও দেখছেন। এমন আশাবাদ অবশ্যই ইতিবাচক। এক সময়ের গোলাম ফারুক অভি, ইলিয়াস আলীরাও ভীষণ মেধাবী ছিলেন। একজন পড়তেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আইআরে। আরেকজন ফিন্যান্সে। রুহুল কবীর রিজভীর মেধা ছিল ঈর্ষণীয়। তিনি রাজশাহী থেকে মাঝেমধ্যে ঢাকা এলে পেছনে পঙ্গপালের মতো নেতাকর্মীদের ভিড় জমত। তার হাঁটাচলা, কথাবার্তার সাবলীলতা, বক্তৃতায় সাহিত্য-কবিতা-ইতিহাসের উদ্ধৃতি দেওয়ার দক্ষতা ছিল ওই সময়ের সেরা। বিজ্ঞান অনুষদ থেকে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্বে আসা হাবিবুন নবী সোহেলের সাহিত্য জ্ঞান-আবৃত্তি প্রতিভা অন্যান্য সংগঠনকেও তব্দা খাইয়ে দিত।

ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগেও গত কয়েক বছর মেধাবী ছাত্রদের সন্নিবেশ করার একটি প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। আইনসহ বিভিন্ন নামকরা বিভাগের ছাত্রদের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আনা হয়েছে। চমৎকার ইংরেজি বক্তৃতা দেওয়া লোকও আনা হয়েছে। তার ইংরেজি বক্তৃতা ব্যাপক প্রচারে-ভাইরালে প্রসার করানো হয়েছে। এটি ভালো দিক। দুটি সংগঠনের মধ্যে এমন মেধা জোগাড়ের প্রতিযোগিতা অবশ্যই ইতিবাচক। এরশাদ পতনের পূর্বাপরে দিনকয়েক পর এমন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েই শেষ হয়ে যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র মাঈনউদ্দিন হাসান চৌধুরীকে নিয়ে আসা হয়েছিল ছাত্রলীগ সভাপতি করে। তার ভদ্রতা-স্মার্টনেস-উচ্চারণ ছিল নজরকাড়া। দিনকয়েকের মধ্যে তাকে আনফিট করে দেয় অন্য মেধাবীরা। মধুর কেন্টিনে তাকে ঠিকমতো বসতেও দেওয়া হতো না।

মঈনু এখন কোথায় চেনাজানা লোকেরাও ঠিকমতো বলতে পারেন না। এর একটু আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাত করা স্মার্ট ছাত্রদল নেতা ছিলেন ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের আলী আক্কাস নাদিম। তার সাবলীল অনর্গল ইংরেজি বক্তৃতা ইংরেজি কম জানাদের কাছেও ছিল সহজবোধ্য। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের কেউ ছাত্ররাজনীতি করে বা করতে পারে, এর দৃষ্টান্ত হিসেবে ছাত্রদল দেখিয়ে দিত নাদিমকে। ছাত্রদলের একাংশ তাকে শুধু বিতাড়নই নয়, নাম-নিশানাও মুছে দিয়েছে। তাদের মেধার কাছে নাদিম পেরে ওঠেননি। ছাত্রদল যদি এখন মেধাবীদের গর্বের জায়গায় রাখে, মেধার গর্ব নিয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে অন্তত একটা শোআপ প্রতিযোগিতায়ও নামে তা ছাত্ররাজনীতিতে কিছু ফল দিতেও পারে।

ছাত্রলীগের গত কয়েক কমিটির মেধাবীদের নিয়ে মূল থেকে গর্ব করা হয়েছে। বলা হয়েছে অস্ত্র নয়, বই-কলম নিয়ে থাকতে। অধ্যবসায় করতে। কিন্তু তাদের অধ্যবসায়ের অধ্যায়টা গর্ব করার জায়গায় নেই। কারও টোকেনে-সিøপে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। ভিসির সঙ্গে টেন্ডারের টাকা ভাগজোগের কাজে মেধা ব্যয় হয়েছে। সেই সঙ্গে চাঁদাবাজি-দখলবাজি তো মামুলি। এগুলোও অবশ্যই মেধার কাজ। তবে অ্যাকাডেমিক মেধা নয়। জগন্নাথের আলোচিত সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যেনতেন নয়, দুর্দান্ত সাহসী ছিলেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে না এনে তাকে ইনাম হিসেবে দেওয়া হয়েছে শিক্ষকতা। তর তর করে পদোন্নতি। অবন্তিকা বিষয়ক ডিস্টার্বটা না হলে মেধার আরও বিকাশ ঘটিয়ে তার ভিসি পর্যন্ত উঠে যাওয়া বিষয়ই ছিল না। গুণে-মানে তার চেয়ে কম পারফরমেন্স করা কতজনই এ পর্যায়ে বা আরও ওপরেও চলে গেছেন। এখানে দ্বীন বা ইসলাম, ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ বিষয় নয়। বিষয়-আসয় অন্যখানে। আসল বিষয় ক্ষমতা। ক্ষমতা চরিতার্থ বা বাস্তবায়নের উপায় বের করা। ছাত্রলীগ আর ছাত্রদল সেখানে একটি মোকাম মাত্র।

আত্মহত্যাকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকাও দুর্দান্ত মেধাবী ছিলেন। এ আত্মহত্যার ঘটনায় আটক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও শিক্ষার্থী আম্মানও মেধাবী। এ আত্মহত্যার প্ররোচনায় তাদের সম্পৃতক্তা পাওয়ার তথ্য গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানও অত্যন্ত মেধাবী। এই ইস্যুতে চেতনায় চেত এনে চটে যাওয়া ছাত্রদল নেতারাও মেধাবী। তারা এ ঘটনায় দায়ী করছেন ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। ছাত্রদলের এই বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে ছাত্রলীগ। তারা বলছে, ‘অবন্তিকা আমাদের বোন। তার মৃত্যুতে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তার মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে। এতে কোনো ছাড় নাই’।

ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগরসহ আশপাশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা হচ্ছে বা হয় কিংবা হয়ে আসছে তার সবই গোপন থাকছে না। ঘটনাচক্রে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষাগুরু এবং ক্ষমতাসীন দলের কিছু ছাত্রগুরুর কাণ্ডকীর্তি সাধারণ মানুষকে কেবল ব্যথিত করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ও বদদোয়া করা ছাড়া তাদের আর করার কিছু নেই। জাগতিকভাবে এরা এখন অধরা। ঘটনাচক্রে দুয়েকটা ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে কথার চাতুরিতে, বিবৃতির মারে, শাসনের কারসাজিতে, আইনের প্যাঁচে তাদের পার পেয়ে যাওয়াটা তাদের অধিকারের মতো। অঘোষিত এক এনওসিতে তাই তারা যা পারে করে চলেছে। কেউ আইনের আশ্রয় নিলে পড়ে আরও বিপদে। চাঁদাবাজি, ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনায় ছয় মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা পাঁচটি মামলারই করুণ দশা এখন। এগুলোর মধ্যে চারটি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ। একটি করেছেন ঠিকাদার। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করা আসামি ১৯ জন। এখনো একজনকেও ধরতে পারেনি বা ধরেনি পুলিশ।

আসামিরা কিন্তু দিব্যি ঘোরে। পুলিশের সঙ্গে হাই-হ্যালো দেয়। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষের করা তদন্ত কমিটিও প্রতিবেদন দেয়নি। বলছে তদন্ত চলছে, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ রোজার মধ্যেই জমি দখলের সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে জয়পুরহাটে ছাত্রলীগ নেতার পিটুনি খেয়ে এসেছেন স্থানীয় চার সাংবাদিক। জয়পুরহাটের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জমি দখল চেষ্টার সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা ও তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে মার খেয়ে হাসপাতালের বেডে কাঁতরাচ্ছেন তারা। বাস্তবতা বলছে, এই সাংবাদিকরা মেধাহীন। যাবতীয় মেধা সেখানকার ছাত্রলীগ নেতা ও তার বাহিনীর। রোজার মধ্যে মেধাহীন সাংবাদিকরা সেখানে যান কেন? সেখানে মেধাবানদের কাজে বাধা দেওয়া মেধাহীনতার প্রমাণ। বিচারের প্রশ্ন এলে কথা তো তৈরি করাই আছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে, যে দলেরই হোক কোনো ছাড় দেওয়া হবে না, একদম জিরো টলারেন্স।

এভাবে করতে পারা, বলতে পারা অবশ্যই মেধার কাজ। আর মেধা অবশ্যই ঐশ্বরিক। কে কীভাবে তার মেধাকে ব্যবহার করবে তা ভিন্ন বিষয়। ব্যবহারকারীদের কাছে সদ্ব্যবহার আর অপব্যবহার একেবারেই আপেক্ষিক। মেধাগুণে উচ্চশিক্ষিতরা বাজে কাজ করবেন না সেই প্রত্যাশা আর নেই। ভিসি-প্রক্টর ধরনের লোকেরা উচ্চশিক্ষিতের চেয়েও উচ্চজন। তাদের অধীনস্থ শিক্ষার্থীরা সবাই মেধাবী। মেধাবী হওয়ার পরও তাদের মধ্যে আরও মেধাস্থানে পৌঁছার প্রতিযোগিতা। তা পড়াশোনায় হোক আর মোজ মাস্তির জন্য হোক। একে দোষ-গুণের আওতায় আনার অবস্থা আর নেই।

নইলে শিক্ষা এবং কর্মজীবনের বর্ণাঢ্যতার দীর্ঘ ভোগ-সম্ভোগ কাটানোর পর জনসেবার নাম করে রাজনীতিতে মাথা ঢোকানোর জানপ্রাণ চেষ্টা কেন? কেন ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল নেতাটিকে হাত করে ধীরে ধীরে কেন্দ্রের বড় নেতাদের বাসাবাড়ির দিকে পা বাড়ানো? অবশ্য পাকা শেয়ানারা এখন চাকরি বা কর্মজীবনে থাকতেই সেই লাইনটি পোক্ত করে ফেলেন। লীগ বা দলের ছাত্রটিকে করে ফেলেন তল্পিবাহক বা গেটিস। এটিও মেধারই কাজ। মোট কথা মেধার কোনো সংকট বা ঘাটতি নেই। উপচেপড়া মেধাতেই বরং যত সর্বনাশ। অবন্তিরা যার শিকার মাত্র। আর ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সেখানকার একটা মাধ্যম বা ভাণ্ড। টেন্ডার, চাঁদাবাজি, দখল, শিক্ষার্থী নির্যাতন, সিট বাণিজ্য তাদের খাত। দ্বীন ইসলাম- আম্মানরা মামুলি দুয়েক পিস সিস্টেম লস। এসবের পেছনে রাজনীতির দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনার কথা কার না জানা আছে? ক্ষমতা, অর্থবিত্ত ও বিলাসী জীবনের জন্য তা অবান্তর-অপ্রাসঙ্গিক নয়, বরং স্বাভাবিক।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট

mostofa71@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION